ই-সেবা

পছন্দের কিছু লিংক

গুরুত্বপূর্ণ সরকারি লিংকসমূহ

 
 
 
মৎস্য চাষ
স্বল্প পুঁজিতে কাঁকড়া চাষ

 

বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল ও প্লাবন (মেনগ্রোভ) সংলগ্ন এলাকা কাঁকড়া চাষের জন্য উপযোগী। আলোচ্য পদ্ধতিতে বাঁশের বন্ধ খাঁচাতে কাঁকড়ার পরিচর্যা বা খাবার দেয়ার কাজটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। মলটিন বা খোলস বদলানোর সময় একে অন্যকে খাওয়ার প্রবণতা থাকে না বলে বাঁচার হার বেড়ে যায়। এ পদ্ধতিতে নদী বা মোহনায় খাঁচা বসিয়ে কাঁকড়া পালন করা হয় বলে কাঁকড়া প্রাকৃতিক পরিবেশেই তাড়াতাড়ি বেড়ে ওঠে। এ নিয়ে লিখেছেন বকুল হাসান খানভাসমান বাঁশের খাঁচায় কাঁকড়া পালন। বিদেশি দাতাসংস্থা ডি এফ আই ডি এর সুপার সাপোর্ট ফর ফিসারিজ এডুকেশন অ্যান্ড রিচার্স প্রকল্পের আর্থিক সহযোগিতায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সামুদ্রিক বিজ্ঞান ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ জাফর গত বছরের গোড়ার দিকে কক্সবাজারের চকরিয়া, সুন্দরবন, রামপালের ভাগাই এবং সাতক্ষীরায় মুন্সীগঞ্জের উপকূলীয় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণের মাধ্যমে কাঁকড়া চাষের সম্ভাব্যতা পরীক্ষণ নামে এক গবেষণা কার্যক্রম শুরু করেছিলেন। ভাসমান বাঁশের খাঁচায় কাঁকড়া পালন তার সেই গবেষণা কার্যক্রমে সাফল্য মিলেছিল সাংঘাতিক। সেখানকার গরিব চাষীদের ও ভাগ্যের দুয়ার গিয়েছিল খুলে। জীবন নকশায় আজ জানা যাক, সেসব প্রযুক্তির বিষয়: 


 

কাঁকড়া চাষ : বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল ও প্লাবন (মেনগ্রোভ) সংলগ্ন এলাকা কাঁকড়া চাষের জন্য উপযোগী। আলোচ্য পদ্ধতিতে বাঁশের বন্ধ খাঁচাতে কাঁকড়ার পরিচর্যা বা খাবার দেয়ার কাজটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। মলটিন বা খোলস বদলানোর সময় একে অন্যকে খাওয়ার প্রবণতা থাকে না বলে বাঁচার হার বেড়ে যায়। এ পদ্ধতিতে নদী বা মোহনায় খাঁচা বসিয়ে কাঁকড়া পালন করা হয় বলে কাঁকড়া প্রাকৃতিক পরিবেশেই তাড়াতাড়ি বেড়ে ওঠে। 


যেভাবে খাঁচা তৈরি করবেন : প্রথমেই লাগবে বাঁশ। সঙ্গে লাগবে প্লাস্টিক ড্রাম আর সুতা। খাঁচার আয়তন অনুযায়ী এক বা ১.৫ সে. মি. মোটা করে ফালি করতে হবে বাঁশ। এরপর এগুলোকে শক্ত চিকন সুতা দিয়ে পাশাপাশি গেঁথে বানা তৈরি করতে হবে। বানাগুলোকে এবার খাঁচার আকৃতি (দৈর্ঘ ী প্রস্থ ী উচ্চতা) বুঝে পাশাপাশি সংযুক্ত করে বানাতে হবে খাঁচা। খাঁচাটা (৭ ী ৩ ী ১) ফুট আকৃতির হলেই সবচেয়ে ভালো হয়। এতে থাকবে ৬০টি প্রকোষ্ঠ। প্রত্যেক প্রকোষ্ঠের আয়তন (৭ী৭ী১০ ) ইঞ্চি করে হবে। ওপরের ঢাকনাটাও এমন বাঁধতে হবে যেন খাবার দেয়া পরিচর্যা আর স্থানান্তর সুবিধা হয়। 


পানিতে খাঁচা বসানো : পানিতে খাঁচা বসানোর ক্ষেত্রে জোয়ার-ভাটা ভালো মতো হয় এ রকম চ্যানেল বা মোহনায় লোনা পানির বাছতে হবে। খাঁচাটাও বসাতে হবে এমন করে যেন ভাটার সময় নদীর তলায় লেগে না যায়। খাঁচার ওপরের চার কোণায় চারটি প্লাস্টিকের ছোট ড্রাম বেঁধে দিতে হবে। যাতে এক/দেড় ইঞ্চি ভাসিয়ে রাখতে পারে খাঁচাটাকে। নদীর তলদেশে শক্ত খুঁটি পুঁতে তার সঙ্গে সর্বোচ্চ জোয়ারের উচ্চতা মাথায় রেখে খাঁচাটাকে বেঁধে দিতে হবে। মজবুত রশি দিয়ে। তাতে জোয়ার-ভাটায় ওঠা-নামা করবে খাঁচাটা।


কাঁকড়া মজুদ : ১৮০/২০০ গ্রাম ওজনের নরম খোলস আর গোরাল অপরিপক্ব এমন কাঁকড়াই মজুদ করতে হবে। কাজটা অভিজ্ঞ চাষীর পরামর্শ নিয়ে করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। বছরের যে কোনো সময়ে কাঁকড়া মজুদ করা যায়, তবে বর্ষাকালটাই সবচেয়ে ভালো। আহত বা পা নেই এমন কাঁকড়া মজুদ করাটা ঠিক হবে না। 


খাবারই একমাত্র পরিচর্যা : রোজ সকাল আর বিকালে কাঁকড়া দেহের ওজনের ৫ ভাগ পরিমাণ খাবার দিতে হবে। কুইচ্যা (ইলমাছ) তেলাপিয়া, ছোট মাছ, হাঙ্গরের মাংস, চিংড়ির মাথা ছোট ছোট টুকরা করে দেয়া যেতে পারে খাঁচার এক একটি প্রকোষ্ঠে। এ খাবার দেয়া ছাড়া বাড়তি কোনো পরিচর্যার দরকার নেই কাঁকড়ার। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে দুই বা তিন সপ্তাহের মধ্যেই কাকড়াগুলো বাজারজাত করা উপযোগী হয়ে যাবে। পুরো খাঁচা তুলে এনে চিমটা দিয়ে কাঁকড়া ধরতে হবে। খুব সাবধানে। কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নষ্ট হয়ে গেলে এর কিন্তু দাম কম বাজারে। ধরার সঙ্গে সঙ্গে পা বেঁধে ফেলতে হবে রশি দিয়ে। 


এ পদ্ধতির সুবিধা : ভাসমান বাঁশের খাঁচায় কাঁকড়া পালন সহজ, কম ঝুঁকিপূর্ণ, স্থানান্তর যোগ্য, পরিবেশ অনুকূল আর লাভজনকও। তেমন বিনিয়োগ করতে হয় না বলে বিনা পুঁজিতেই অনেক লাভ করতে পারেন গরিব কৃষকরা। আরো সুবিধা হচ্ছে_ কাঁকড়ার মৃত্যুর হারও এখানে কম, রোগ সংক্রমনের ভয়ও নেই। আবার মাটি ও পানিও দূষিত হয় না। তাছাড়া অল্প জায়গায় অনেক বেশি কাঁকড়াও পালন করা যায়। 


খরচাপাতি : ভাসমান বাঁশের খাঁচায় কাঁকড়া চাষ করেছিলেন যে চাষীরা, তাদের কাছ থেকেই জানা গেল বাঁশের খাঁচা, বাঁশ, সুতা, কাঠ, প্লাস্টিক ড্রাম কেনা বাবদ ১৫০০ টাকা এবং শ্রম মূল্য ১৫০০ টাকা করে ৩০০০ টাকা খরচ হবে প্রথমে এবং একবারই। এরপর প্রতিবার কাঁকড়া পালনে খরচটা হবে এভাবে; ১ কেজি ২০০ গ্রাম কাঁকড়ার দাম ২৫ টাকা হিসেবে ৬০টি বা ১১ কেজি কাঁকড়া কিনতে খরচ হবে ২৭৫ টাকা। ১৫ দিনের খাবার খরচ ২০০ টাকা, আর ১৫ দিনে মোট ৩০ ঘণ্টার শ্রমিক খরচ ৪০০ টাকা। ১ বছরে ২০ বার এক খাঁচায় চাষ করা যাবে, এজন্য প্রতি মাসে কাঁকড়া পালনের জন্য খাঁচা বাবদ খরচ ১৫০ টাকা। অতএব প্রতিবার কাঁকড়া পালনে মোট বিনিয়োগ খরচ ১০২৫ টাকা। ১৫ দিন পালনের পর ১৮০ বা ২০০ গ্রাম ওজনের এক একটি কাঁকড়ার ওজন হবে প্রায় ২৫০ গ্রাম এবং গড়ে ৫০টি কাঁকড়া বেঁচে থাকবে। এতে মোট ওজন হবে (২৫০ ী ৫২=১২৫০০) গ্রাম বা ১২.৫ কেজি। এক কেজি কাঁকড়ার বিক্রয় মূল্য ২০০ টাকা হলে মোট আয় হবে। (২০০ ী ১২.৫=২৫০০) টাকা। অর্থাৎ ১৫ দিনে আসলে লাভ হচ্ছে (২৫০০-১০২৫=১৪৭৫) টাকা। প্রতি দুই মাসে একটা খাঁচা থেকে কমপক্ষে তিনটি ফলনে আয় হবে। (১৪৭৫ ী ৩=৪৪২৫) টাকা। একসঙ্গে সাধারণত চারটা খাঁচায় কাঁকড়া পালন করা হয়। সে ক্ষেত্রে দুই মাসে আয় হবে। (৪৪২৫ ী ৪=১৭৭০০) মাসিক আয় সে ক্ষেত্রে দাঁড়াচ্ছে প্রায় ৯০০০ হাজার টাকার মতো। 


অনুকূল পরিবেশ, সহজলভ্যতা, স্থানীয় ও বিদেশি বাজারে চাহিদা, উচ্চ পুষ্টিগুণ, স্বল্পমূল্যের খাদ্যপ্রাপ্তি, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আগ্রহ এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা মেলে বাংলাদেশের কাঁকড়ার চাষের বিরাট ক্ষেত্র রয়েছে জানালেন গবেষকরা। 
লেখক : কৃষি সাংবাদিক